ঢাকা,সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪

পানিতে ভেসে গেছে ২০ কোটি টাকা মাছ

চকরিয়ায় বন্যার তাণ্ডবে রাস্তাঘাট ও বেঁড়িবাধের ক্ষতি শতকোটি টাকা

কমছে পানি বাড়ছে দুর্ভোগ, ভেসে উঠছে ক্ষত চিহৃ

এম.জিয়াবুল হক, চকরিয়া ::

অভিরাম ভারী বর্ষণ আর মাতামুহুরী নদীতে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কক্সবাজারের চকরিয়ায় স্বরণকালের ভয়াবহ বন্যার প্রাদুর্ভাব ঘটে। এই অবস্থায় গত পাঁচদিন ধরে উপজেলার ১৮ ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা জনপদে ৬ লাখের মধ্যে প্রায় চার লাখ মানুষ ছিল পানিবন্দি। অবশ্য শনিবার থেকে নদীতে পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় বিভিন্ন এলাকায় নেমে যেতে থাকে বানের পানি। তবে লোকালয় থেকে পানি নেমে গেলেও নানা দূর্ভোগে পড়েছেন বানবাসি মানুষ।

এরই মধ্যে বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্র, রাস্তার দ্ধারে আশ্রয় নেয়া লোকজন বাড়িতে ফিরতে শুরু করেছে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর সড়কগুলো যান চলাচলের অনুপোযুগী হয়ে পড়েছে। নলকূপগুলো কয়েকদির ধরে পানিতে ডুবে থাকায় পানি উঠছে না। এতে চরম বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সংকটে পড়েছে বন্যা কবলিত মানুষ।

টানা তিনদিন পর বন্যার পানি লোকালয় থেকে সরে যাওয়ায় এখন ভেসে উঠছে সড়কের ক্ষত চিহ্ন। পানির স্রোতের চাপে বন্যায় উপজেলা এলজিইডি বিভাগের ৩০ কিলোমিটার, সড়ক ও জনপদ (সওজ) বিভাগের ২০ কিলোমিটার, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অধিদপ্তর (পিআইও) বিভাগের অধীন ১৮টি ইউনিয়নে প্রায় একশ কিলোমিটার সড়ক কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা। গতকাল রোববার চকরিয়া উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে একাধিক গ্রামীন সড়ক দেখতে গিয়ে দেখা গেছে বন্যার পানি সরে যাওয়ায় এখন ভেসে উঠছে সড়কের ক্ষত চিহ্ন।

একইসঙ্গে বন্যার পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১৬০ মিটার বেঁিড়বাধ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। সবমিলিয়ে বন্যার তাণ্ডবে চকরিয়া উপজেলাজুড়ে সড়ক ও বেড়িবাধের প্রায় শতকোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সরকারি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।

বন্যার তাণ্ডবে উপজেলার ১ হাজার ৫৩০ হেক্টর জমিতে অবস্থিত ২৫২টি চিংড়িঘের প্লাবিত হয়েছে। এতে ১৯ কোটি ১২ লাখ টাকার ৩৮২ মেট্রিক টন চিংড়ি ভেসে গেছে। পাশাপাশি ভারী বর্ষণে উপজেলার ১৮টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা এলাকায় ৭১২ হেক্টর আউশ, ৩৮০ হেক্টর আমনের বীজতলা, ৬৪৮ হেক্টর রোপা আমন ও ২৫৫ হেক্টর সবজিখেত ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।

উপজেলার বিভিন্ন এলাকা সরজমিন ঘুরে দেখা মেলে বন্যা কবলিত লোকজন খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে যে ত্রাণ দেয়া হয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। উপজেলার সুরাজপুর-মানিকপুর, কাকারা, লক্ষ্যারচর কৈয়ারবিল, বরইতলী, হারবাং, ডুলাহাজারা, ফাঁসিয়াখালী, চিরিংগা, খুটাখালী ও পৌরসভা থেকে পানি অনেকাংশে নেমে গেছে। কিছু কিছু সড়কের বিভিন্ন স্থানে এখনো পানি চলাচল করছে।

উপজেলার সাহারবিল, পূর্ব-বড়ভেওলা, বিএমচর, কোণাখালী, পশ্চিম-বড়ভেওলা, ঢেমুশিয়া এলাকায় বানের পানি এখনো কমেনি। সড়কের বিভিন্ন স্থানে পানি রাস্তা দিয়ে পারাপার করছে।

চকরিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব ফজলুল করিম সাঈদী ইউনিয়ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের উদ্বৃতি দিয়ে জানান, পাঁচদিনের টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে গেছে ঘর-বাড়িসহ রাস্তাঘাট। বানবাসি মানুষ খুব কষ্টে আছেন। সরকারীভাবে ও বেসরকারী উদ্যোগে যে ত্রাণ দেয়া হচ্ছে তা খুবই অপ্রতুল।

তিনি বলেন, উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত বরাদ্দ চেয়ে চাহিদা পত্র পাঠানো হয়েছে। টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ঠ বন্যায় চকরিয়া ১৮টি ইউনিয়ন ছাড়াও পৌরসভা এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বন্যার পানি কমলেও এখন ক্ষতির চিহৃ দৃশ্যমান হচ্ছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড চকরিয়া উপজেলার বদরখালী শাখা কর্মকর্তা (এসও) মো.জামাল মোর্শেদ বলেন, বন্যার তাণ্ডবে মাতামুহুরী নদীর চকরিয়া উপজেলা অংশের ৫ স্থানে ১১০ মিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। ভাঙা স্থান দিয়ে নদীর পানি লোকালয়ে ঢুকছে।

কক্সবাজার পাউবোর চিরিঙ্গা শাখা (এসও) কর্মকর্তা শাহ আরমান সালমান বলেন, পাহাড়ি ঢলের তাণ্ডবে সবচে বেশি ঝুঁিকতে আছে চকরিয়া পৌরশহর বাধের দিগরপানখালী অংশ। ওই এলাকার অন্তত ৫০ মিটার বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে গেছে। বর্তমানে পাউবোর পক্ষথেকে ওই এলাকায় জিওব্যাগ ফেলে বেঁিড়বাধটি রক্ষার চেষ্ঠা চলছে। তিনি বলেন, এটি নদীতে বিলীন হলে গেলে হুমকির মুখে পড়বে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। তাই বিষয়টি বিবেচনা করে আমরা ইতোমধ্যে সেখানে কাজ শুরু করেছি।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) চকরিয়া উপজেলা প্রকৌশলী কমল কান্তি পাল চকরিয়া নিউজকে বলেন, ভারী বর্ষণ আর পাহড়ি ঢলে উপজেলার ১৮ ইউনিয়নে প্রায় ৩০ কিলোমিটার সড়ক কমবেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তদমধ্যে শনিবার সমীক্ষা চালিয়ে আমরা অন্তত চার কিলোমিটার সড়ক বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, তা নির্ণয় করেছি। যার ক্ষতির পরিমাণ ৩ থেকে চার কোটি টাকা।

চকরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এস এম নাসিম হোসেন চকরিয়া নিউজকে বলেন, ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে ১৮টি ইউনিয়ন ও পৌরসভা এলাকায় ৭১২ হেক্টর আউশ, ৩৮০ হেক্টর আমনের বীজতলা, ৬৪৮ হেক্টর রোপা আমন ও ২৫৫ হেক্টর সবজিখেত ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।

অপরদিকে চকরিয়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা বেনজির আহমেদ চকরিয়া নিউজকে বলেন, উপজেলার চিরিংগা, বদরখালী, সাহারবিল, পশ্চিম বড় ভেওলা, ডুলাহাজারা ও খুটাখালী এলাকায় ১১ হাজার হেক্টর জমিতে আনুমানিক ৮১০টি চিংড়ির ঘের রয়েছে। তদমধ্যে ২৫২টি চিংড়িঘের প্লাবিত হয়েছে। এতে ১৯ কোটি ১২ লাখ টাকার ৩৮২ মেট্রিক টন চিংড়ি ভেসে গেছে। এ ছাড়া চকরিয়ার ৮২টি বাণিজ্যিক পুকুর বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ১ কোটি ৬ লাখ টাকার ৫৩ মেট্রিক টন সাদা মাছও ভেসে গেছে।

চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ শামসুল তাবরীজ চকরিয়া নিউজকে বলেন, উপজেলায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পানি পুরোপুরি নেমে যাওয়ার পর মাঠ পর্যায়ে হিসাব করেই জানা যাবে ক্ষতির পরিমাণ। ঘর হারানো পরিবার ও ভেঙ্গে যাওয়া সড়ক নির্মাণের মাধ্যমে যোগাযোগ সচল করা অগ্রধিকার দেয়া হবে।

তিনি বলেন, বন্যা দূর্গত এলাকায় খাবার পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট সরবরাহ করা হচ্ছে। এছাড়াও প্রতিটি ইউনিয়নের জন্য ৪টন চাল ও শুকনো খাবার দেয়া হয়েছে। আরো ২৮ টন চাল ও শুকনো খাবার বরাদ্দের জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

এদিকে অপরদিকে, বন্যায় দূর্গত মানুষের চিকিৎসা সহায়তায় চকরিয়ার উপজেলার ১৮ ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার জন্য মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। পাঁচদিনের টানা বর্ষণ ও বন্যার কারণে দুর্গত এলাকায় দেখা দিয়েছে ডায়রিয়া, আমাশয়, জ্বরসহ পানিবাহিত নানা রোগব্যাধি। এছাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকে থেকেও বিশেষ ব্যবস্থায় দুর্গতদের দেয়া হচ্ছে চিকিৎসা সেবা।

চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প:প: কর্মকর্তা (টিএইচ) ডা.মোহাম্মদুল হকের বরাত দিয়ে হাসপাতালেল তথ্য কর্মকর্তা পলাশ সুশীল চকরিয়া নিউজকে বলেন, উপজেলার ১৮টি ইউনিয়ন এবং ১টি পৌরসভার জন্য ৫ সদস্য বিশিষ্ট মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। প্রত্যেক টিমে একজন করে মেডিকেল অফিসার কাজ করছে।

এদিকে, বন্যাদূর্গত এলাকায় কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব জাফর আলম, উপজেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে সৈয়দ শামসুল তাবরীজ, চকরিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যার আলহাজ্ব ফজলুল করিম সাঈদীর নেতৃত্বে উপজেলা পরিষদ, পৌরসভার মেয়র মো.আলমগীর চৌধুরীর নেতৃত্বে পৌর প্রশাসন, মেয়রপ্রার্থী জিয়াবুল হক ছাড়াও আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দ ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী এবং বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তি শুকনো খাবার, চাল-ঢাল, খিচুড়ি বিতরণ করছেন। কিন্তু বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থরা দাবী করেছেন ত্রাণ পর্যাপ্ত নয়। কেউ কেউ পেলেও অনেকেই পায়নি।

 

 

পাঠকের মতামত: